নিজস্ব প্রতিবেদনঃ
জাতীয় সংগীত নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ
“দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান জালিম শাহীর কারাগারে বন্দীদশা শেষে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসার বারোদিন পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার সাথে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা থাকলে আমি আর কিছুই চাই না।”
বঙ্গবন্ধু বলেন, “নাটক নয়, উপন্যাস নয়, কবিগুরুর গান ও কবিতাই আমার বেশি প্রিয়। সব মিলিয়ে এগারো বছর আমি জেলে কাটিয়েছি। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। জেলে বসে কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখুস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলে নয় মাস বন্দি ছিলাম সঞ্চয়িতা আমার সঙ্গে ছিল না। আমি বড় কষ্ট পেয়েছি। আমার একটি প্রিয় গানকেই “আমার সোনার বাংলা” আমি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত করেছি। আর হ্যাঁ, আমার আর একটি প্রিয় গান ডি.এল রায়ের “ধন ধান্য পুষ্প ভরা”। দুটি গানই আমি কাজের ফাঁকে গুনগুন করে গেয়ে থাকি’’।
‘আমার সোনার বাংলা’ জাতীয় সংগীত হওয়ার ইতিহাসঃ
১৯৫৬ সালে ঢাকায় পকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠানের। উদ্যোক্তা ছিলেন গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। সেই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের নির্দেশে “আমার সোনার বাংলা” গানটি পরিবেশন করেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ সানজীদা খাতুন। শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদেরকে জানান দিতে চেয়েছিলেন যে এই গানটি বঙালিকে কতখানি আবেগ তাড়িত করে।
১৯৬১ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরীর অন্যতম গান হয়ে ওঠে ‘‘আমার সোনার বাংলা’’ এ গানকে বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে দিলেন। ১৯৬৭’র আন্দোলনের সব চাইতে স্থায়ী ফসল “আমার সোনার বাংলা” গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠা।
একাত্তরে পাক হানাদারদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালির রক্তকে ফেনিয়ে তুলতে এবং স্বাধীনতার যুদ্ধে মৃত্যুর প্রতিরোধ ও জীবন সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল পাথেয় ও প্রেরণা। ১৯৭০ সালের গোড়ায় বঙ্গবন্ধু জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রের্কড প্রকাশের জন্য। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’ এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বেতার টিভিতে সোনার বাংলা গানের রের্কড বাজতে থাকে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দিকে দিকে মুক্তিকামী মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় “আমার সোনার বাংলা” গানটি।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জনসভা। বঙ্গবন্ধু সদ্য নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের শপথ করালেন, কেউ ৬ দফা থেকে এক অক্ষরও সরবে না, সরতে পারবে না। সভার শেষে দুটো গান পরিবেশিত হয়। ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ আর ‘আমার সোনার বাংলা’।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়।
১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যার্বতন দিবস। সেদিন বিমানে লন্ডন থেকে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী হয়েছিলেন ভারতীয় কূটনৈতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। তিনি তার ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সঙ্গীত’ বইয়ে লিখেছেন-‘‘ ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি লন্ডন হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি নিয়ে বিমানটি উড়ছে। বঙ্গবন্ধু জানালা দিয়ে শ্বেতশুভ্র মেঘের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর গাইতে লাগলেন, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তাঁর চোখে জল। তিনি বললেন ব্যানার্জি, আপনিও ধরুন। রিহার্সেল দিয়ে নেই। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলে উঠলেন, এ গানটি হবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। কেমন হবে বলেন তো?”
শশাঙ্ক জবাব দিলেন, “ইতিহাসে তাহলে প্রথমবারের মতো দুটি দেশের জাতীয় সংগীতের লেখক হবেন একই ব্যক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রূপে আর ডি এর রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ জাতীয় গীত হিসেবে গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু বলেন, যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, সেটিই জাতীয় সংগীতের সুর। বাঙালি বলে যে জাতির কথা রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই জাতিকেই আবিষ্কার করেন সোনার বাংলায়।
বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। রাষ্ট্র দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের গৌরববোধ দিয়েছেন, দিয়েছেন জাতীয় সংগীতের বাণী।
এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘সেদিন রাতে খেতে বসে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে গম্ভীর হয়ে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেশটা যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তাহলে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটিকে গ্রহণ করো।”
রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ সানজীদা খাতুন ‘জীবনের ভেলায় ভেলায়’ বইতে লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি এ গানটি যখন শুনতেন তখন কেঁদে ফেলতেন। এ থেকেই বোঝা যায় তিনি দেশকে কতটা ভালোবাসতেন।
জাতীয় সংগীতের ব্যাখ্যাঃ
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
ব্যাখ্যাঃ স্রষ্টা পৃথিবীকে তার মনের মতো করে অপরূপ রূপে সাজিয়েছেন। বাংলার সেই রূপ অবলোকন ও হৃদয়ে ধারণ করে কবি তাকে সোনার সাথে তুলনা করেছেন। কারণ এ মাটিতে কোনো প্রকার বীজ পড়লেই তাতে গাছ জন্মায় মহুমূল্য ফল আর ফসল জন্মায়।আর সেই বাংলাকেই কবি ভালবাসেন।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥
ব্যাখ্যাঃ বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতু বৈচিত্রের কারণে প্রকৃতি বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য রূপ ধারণ করে। প্রত্যেক ঋতুতে বাংলার আকাশ বিচিত্র অবয়বে আমাদের হৃদয়ে দোলা দেয় এবং ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে বাতাসের গতি-প্রকৃতি, ধ্বনি আমাদের কানে বাঁশির সুর তোলে। তাই কবি বাংলার আকাশ এবং বাতাসে এই মধুর মিলনকে বাঁশির সুরের সাথে তুলনা করেছেন। আর সেই বাংলাকে কবি ভালবাসার কথা বলেছেন।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ব্যাখ্যাঃ পৃথিবীতে স্রষ্টার পরে যদি কেউ কাউকে ভালবাসেন সে হচ্ছে তার মা।কবি দেশকে এতটাই আপন ভেবেছেন যে, তাকে মায়ের সাথে তুলনা করেছেন। এখানে তার দেশপ্রেম এবং মাতৃভক্তির প্রকাশ পেয়েছে। দেশপ্রেম ইমানে অন্যতম অংশ। ফাগুন মাসে আমের শাখায় নতুন মুকুল ধরে, গাছে নতুন পত্র-পল্লব গজায়। প্রকৃতির সেই নতুন রূপে ফিরে আসাতে এবং অম্রমুকুলের ঘ্রাণে কবি আনন্দে আন্দোলিত হয়েছেন। এবং আবেগতারিত হয়ে কবি দেশকে মা বলে সম্বোধন করেছেন। আর সেই বাংলাকে কবি মা বলে ডাকতে বলেছেন।
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
ব্যাখ্যাঃ অঘ্রহায়ণ মাসে ফসলের ক্ষেতে কৃষকের মুখভরা হাসি দেখে কবি অবাক হয়েছেন।সোনার ফসল পেয়ে কৃষক-কৃষাণীর মুখের হাসিতে যেন মধু ঝরে।কবি অবাক বিস্ময়ে সেই হাসি অবলোকন করেছেন।বাংলার গরীব চাষা-চাষির সেই হাসিকে মধুমাখা হাসির সাথে তুলনা করেছেন। সেই বাংলাকে কবি ভালবাসেন।
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে ।
ব্যাখ্যাঃ বাংলার অপার রূপ, প্রকৃতি, বৃক্ষ, পাতা পল্লব, লতা, ফুল এবং তার নয়নাবিরাম দৃশ্য, তার স্পর্শ কবির কাছে মাতৃস্নেহের মতো মনে হয়।এই ফল ফুল বৃক্ষ লতা পাতার মধ্যে কবি এক অদ্ভুত মায়া খুজে পান। মনে হয় যেন প্রকৃতি তার ছায়া ও স্নেহে আমাদের আপন সন্তানের মতো মাতৃ মায়ায় আবদ্ধ করে রেখেছেন।ক্লান্ত পথিক, কৃষক,গেরস্থ চৈত্রের রৌদ্রে নদীর কূলে সারি সারি বটের ছায়ায় মায়ের আঁচলস্পর্শ অনুভব করে।বটবৃক্ষ যেন মায়ের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত সন্তানের জন্য শীতল পাটি বিছিয়ে রেখেছে।এই মহান অনুভুতিকে কবি মায়ের আঁচলের সাথে তুলনা করেছেন।আর আমি আমার মাকেই ভালবাসি।
মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,
মরি হায়, হায় রে—
ব্যাখ্যাঃ সন্তান জন্ম থেকেই মায়ের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে।মা তার সন্তানকে সুন্দর সুন্দর শব্দ কথা বা বুলি শেখান। আর প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার মায়ের মুখের বুলি স্বর্গের সুধার মতো অনুভব হয়।ঠিক তেমনিভাবে কবি বাংলার প্রকৃতিতে নদ-নদীর কল কল ধ্বনি, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ, কুকিলের সুমিষ্ট গান, বাতাসের শন শন শব্দ, বৃষ্টির ঝিরি ঝিরি ধ্বনি, বাংলার মেঠপথে বাউলের গান, সন্ধ্যায় মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, ফজরে মুয়াজ্জিনের আহবান কবির কাছে বেহেশতি সুধার মতো মনে হয়।তাই কবি আমার মায়ের মুখের কথাকে স্বর্গীয় সুধার সাথে তুলনা করেছেন।আর আমি আমার সেই মাকেই ভালবাসি।
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥
ব্যাখ্যাঃ সেই আমার মা যিনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, আমাকে লালন পালন করেন, আমাকে খাবার দেন, শিক্ষা দেন।সেই মা যিনি আমাকে শত ব্যাথা-বেদনায় তার শীতল আঁচলে আগলে রাখেন, আমার সেই মায়ের মুখ যখন মলিন হয় আমি ঠিক থাকতে পারিনা, আমি কান্নায় ভেঙ্গে পরি। আমি পাগলপ্রায় হয়ে যাই।কবি বলেছেন যখন আমার বাংলা মায়ের বুকে প্রকৃতির বিরুপ দৃষ্টি পরে, যখন প্রাকৃতিক বিপদ আসে, যখন মনুষ্য বহিঃশত্রু আমার মায়ের বুকে উলঙ্গ দখলদারীত্বে নৃত্য নাচে, যখন অপশক্তি পরাশক্তি কুশক্তি আমার মায়ের বুকে রক্তবন্যা বহায়, যখন কুসংস্কার তার সন্তানদের অন্ধকারে আহবান করে, যখন অজ্ঞতা তার সন্তানদের একে অন্যের শত্রুতে পরিনত করে, তখন কবির নয়ন জলে ভাসে, কবির দুঃখ হয়, হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়।
আমি মনে করি এই সঙ্গীতের মাধ্যমে কবি মা তথা দেশকে ভালবাসতে উদ্ভুদ্দ করেছেনে। এই সঙ্গীতে দেশপ্রেমের অপার দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। এবং প্রকৃতির অপরূপ শোভা এবং বৈচিত্রের বর্নণা করে কবি স্রষ্টা কতো সুন্দর তার ক্ষমতা কতো অসীম তাও প্রমাণ করেছেন। এই কথা এই ব্যাখ্যা এই অনুভুতি আমি এইচ এম শামীম আমার একান্ত ব্যক্তিগত।দয়াকরে কেহ এই ব্যাখ্যাকে অন্যভাবে কিংবা কারো অনুভূতিকে আঘাত করার উদ্দেশ্য হিসেবে দেখবেন না। সকলের মঙ্গল হউক।
ব্যাখ্যাঃ এইচ এম শামীম
আরও পড়ুন
মেরিল্যান্ডে নবনির্মিত বাংলাদেশ হাউসের উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রীর
আপনার মতামত লিখুন :